Story No-1
ভোরের প্রথম পাখিটার ডাকেই ঘুম ভেঙে গেল শুভ্রবাবুর। এখন আর ঘুমটা অত গভীর হয়না। হবেই বা কি করে, দিন দিন বয়সটা বাড়ছে বই তো কমছে না, দেখতে দেখতে প্রায় তিন কুড়ি হতে চললো। মুখের বলিরেখা গুলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আরও। তবে সেইজন্য তার আফশোস হয়না, বরং বেশ ভালই লাগে। মুখের ওপর সেই অবিন্যস্ত আঁকিবুকি গুলো তার কাছে যেন জীবনের অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
চোখ মুখ ধুয়েই তার চোখ চলে গেল ক্যালেন্ডারের দিকে। আজ রোববার। তারমানে ছেলে, বৌমা, নাতনি সবাই আজ বাড়িতে। ছুটির এই দিনটা বেশ ভালো লাগে ওনার। সবার সঙ্গে সময় কাটানো বলতে এই একটাই তো দিন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবার সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্খাটাও যে একটু একটু করে তীব্র হয়ে উঠছে সেটা বেশ বুঝতে পারেন। কিন্তু তারিখের দিকে নজর পড়তেই মনটা কেমন যেন দমে যায় তার। পুরনো মন খারাপ গুলো আস্তে আস্তে ভিড় জমাতে লাগে মনে। ক্যালেন্ডারে তখনও লাল কালিতে জ্বলজ্বল করেছে আজকের তারিখ - ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০৬০।
সকালের জলখাবার খেয়ে আজ সবাই ভিড় জমিয়েছে শুভ্রশেখরের ঘরে। ওনার আকস্মিক তলবেই এই ব্যবস্থা। খাটের ওপর গোল হয়ে বসেছে তনয়, মিলি, তাদের একমাত্র মেয়ে সোমলতা এবং শুভ্রবাবু। তনয়ই প্রথম নিরবতা ভেঙে বলে ওঠে, "বাবা হঠাৎ ডেকে পাঠালে যে? কোনো সমস্যা কি?"
"হ্যাঁ বাবা কিছুই তো বুঝতে পারছি না", উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে ওঠে মিলি।
শুভ্রবাবু একটু দম নিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, " আজ তোমাদের একটা গল্প বলবো বলে ডেকে এনেছি।"
"গল্প!", চোখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সোমলতার।
"হ্যাঁ গল্প, আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে অর্থাৎ ভালোবাসা দিবস, যদিও আমি মনে করি কাউকে ভালবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিনের প্রয়োজন হয়না তাও ভাবলাম আজকের দিনেই তোমাদের এই গল্পটা শোনাবো।"
গল্পের টানে সবাই চুপ করে বসে আছে। ঘরে একটা পিন পড়লেও বোঝা যাবে এমন অবস্থা। শুভ্রবাবু টেবিলের ওপরে রাখা মৃত স্ত্রী এর ছবির দিকে একবার চেয়ে নিলেন, নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিচ্ছেন যেন। সমস্ত ভাবনা চিন্তাগুলোকে মোটামুটি একটু সাজিয়ে নিয়ে তিনি শুরু করলেন...
"ঋজু বেশ তাড়াতাড়িই ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল। তার বয়স সবে চব্বিশ। যৌবনের তখন সূচনা লগ্ন মাত্র। খুব ছোটবেলাতেই বাবা মারা যাওয়ায় মায়ের কাছেই মানুষ হয় সে। তাই এই চাকরিটার বড্ড প্রয়োজন ছিল তার। মাইনে পত্র বেশ ভালই। বাড়িতে প্রাণী বলতে তো তারা দুইজন। সেই টাকায় হেসে খেলে তাদের চলে যাবে, এমনকি ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখার টাকারও অভাব হবে না। সেই সঙ্গে অন্তত তার মা'ও এবার একটু বিশ্রাম পাবে, জীবনের বেশিরভাগ সময় তো ঋজুর কথা চিন্তা করতে করতেই কেটে গেল তার।
সেদিনের আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। উজ্জ্বল মেঘহীন এক সকাল। তবে রোদের তেজ খুব একটা বেশি নয়, সাথে মৃদু মন্দ হাওয়া বইছে। ব্যাঙ্কে ঋজুর আজ প্রথম দিন। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই সে বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়েছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাস আসছে কিনা সেটা দেখার জন্য ডানদিকে তাকাতেই সে বাস দেখতে পেলো না বটে কিন্তু একটা মায়াবী মুখ তার সামনে ভেসে উঠল। ঋজু তার দৃষ্টি এবার ভালো করে সেই মায়াবী মুখের অধিকারীর দিকে নিক্ষেপ করে। তারই বয়সী একটি ছেলে। তার পরনের বস্ত্র মলিন হলেও পরিষ্কার। মুখে একটু হলেও দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। তবে তারজন্যই যেন আরো মায়াবী লাগছে তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস চলে এলো। ঋজু লক্ষ্য করল সেই ছেলেটিও তার সঙ্গে একই বাসে ওঠার উপক্রম করছে....
এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে তিন তিনটি মাস। ঋজুর জীবন কেমন যেন একটা ছকে বাঁধা পড়ে গেছে। সারাদিন বাড়ি থেকে ব্যাঙ্ক আর ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি করেই কেটে যায় তার। আর সেই ছেলেটির সঙ্গে রোজ সাক্ষাৎও সেরকম একই গতে বাঁধা। সে প্রত্যেক দিন সেই স্ট্যান্ডে একই বিষাদ মাখানো মুখে দাড়িয়ে থাকে। কেবল মাসের প্রথম কয়েকদিন তার মুখটা বেশ হাসিখুশি দেখায়, হয়তো মাইনে পাওয়ার আনন্দে। তারপর সে ঋজুর সঙ্গে একই বাসে ওঠে আর তার গন্তব্যের ঠিক আগের স্টপেজেই নেমে যায়। ঋজু প্রত্যেক দিন আড় চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছে তার সাথে। কিন্তু ছেলেটি একবারও চোখ সরিয়ে নেয়নি বরং লজ্জা পেয়ে ঋজুই একসময় চোখ নামিয়ে নিয়েছে।
আজ কিন্তু স্ট্যান্ডে এসে সেই ছেলেটির দেখা পাওয়া গেল না। ঋজু কেমন যেন মুষড়ে পড়লো, সাথে মনে মনে একটু অবাকও হলো। এরকম অপরিচিত একটা ছেলে যার সাথে কোনো চেনাশোনা নেই এমনকি একটা শব্দ বিনিময় পর্যন্ত হয়নি তার জন্য.... চিন্তাটাকে মাথার মধ্যে চেপে বসতে দিল না সে। ব্যাঙ্কে পৌঁছে নিজের কাজে মনোনিবেশ করল।
লাঞ্চ টাইম সবে শুরু হলো বলে। কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে খাওয়ার তোড়জোড় করছে। ব্যাঙ্কে তখন ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে। এমন সময় একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে সেখানে প্রবেশ করলো। ঋজু নিজের কেবিনে বসে টিফিন বক্সটা খুলে ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে। বাইরে থেকে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। একজন কর্মচারী তার দরজায় টোকা দিয়ে বলল
- আসবো স্যার?
- হ্যাঁ এসো।
- স্যার একজন টাকা তুলতে এসেছে, কিন্তু ওনার ডকুমেন্টস গুলোতে একটু সমস্যা থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু উনি বার বার করে বলছেন যে বড্ড বিপদে পড়েছেন। আমরা কিছু করতে পারবো না শুনে বলছেন আপনার সাথে দেখা করবেন। স্যার তাহলে কি পাঠিয়ে দেবো?
ঋজু কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর সামনে রাখা খোলা টিফিন বক্সটা বন্ধ করে বললো
- আচ্ছা দেখি পাঠিয়ে দাও তাহলে।
- আচ্ছা স্যার।
কর্মচারী লোকটি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ঝড়ের গতিতে কেবিনে প্রবেশ করলো। তাকে দেখেই ঋজু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। বাসের সেই ছেলেটি! ছেলেটির মুখেও ক্ষণিকের একটা মিশ্র ভাব খেলা করেই অসহায়তাটাই বেশি করে ফুটে উঠলো। তারপর সে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলো
- স্যার আমার বাবা হসপিটালে ভর্তি। এক্ষুনি কিছু টাকার প্রয়োজন। কিন্তু ওরা বলছে কিসব গোলমাল আছে তাই টাকা এখন তুলতে পারবো না, স্যার আপনার পায়ে পড়ি কিছু একটা করুন প্লিজ।
- আচ্ছা আচ্ছা আপনি বসুন আগে। ব্যাঙ্কের পাসবই আর চেকবইটা সাথে করে এনেছেন তো?
- হ্যাঁ স্যার ওই দুটো সাথেই আছে
বলে সেই দুটো জিনিস ঋজুর দিকে বাড়িয়ে দিল সে। ঋজু সেগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে কম্পিউটারে কিসব টাইপ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কম্পিউটার স্ক্রীন থেকে মুখ সরিয়ে বললো
- আচ্ছা আপনার প্যান কার্ডটা এনেছেন?
- না স্যার ওটা তো আনিনি।
- তাহলে তো আমার কিছু করার দেখছি না।
- প্লিজ স্যার কিছু একটা করুন। টাকা গুলো সত্যি আমার খুব দরকার প্লিজ স্যার...
বলে কাঁদতে লাগলো সে। ঋজু কিছু একটা ভাবলো তারপর বলল
- আচ্ছা আপনার প্যান কার্ডের নম্বরটা মনে আছে?
- হ্যাঁ.... হ্যাঁ স্যার আছে।
- আচ্ছা ওটা আমাকে বলুন।
ছেলেটি গড়গড় করে নম্বর গুলো বলে গেল। ঋজু কয়েকটা কাগজে কিছু লিখে নিয়ে পাসবই আর চেকবই দুটোর সাথে একটা কাগজ ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল
- আচ্ছা আপনার নাম সবুজ চক্রবর্তী তাইতো?
- হ্যাঁ স্যার।
- যান আপনার কাজ হয়ে গেছে। টাকা তোলার সময় এই কাগজটা দেখাবেন। আশা করি কোনো সমস্যা হবে না। আর কাল সকালে এসে মনে করে অবশ্যই আপনার প্যান কার্ডের এক কপি জেরক্স দিয়ে যাবেন, নাহলে কিন্তু আমাকে সমস্যায় পড়তে হবে।
- আচ্ছা স্যার। আপনি আমার বড্ড উপকার করলেন। আমি কাল ঠিক সময়ে এসে ওগুলো আপনাকে দিয়ে যাব। আচ্ছা স্যার বলছি আপনার ফোন নম্বরটা দেবেন? মানে... ইয়ে আরকি দরকার থাকলে কোনো...
- আচ্ছা বলছি লিখে নিন।
- অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার।
নাহ সবুজের সত্যি দায়িত্ববোধ আছে। পরের দিন ঋজু ব্যাঙ্কে গিয়েই দেখে সে তার আসার আগেই জেরক্স কপিটা জমা দিয়ে গেছে। তার ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগে। গতকালের কথা মনে পড়ে যায়, ছেলেটা উদভ্রান্তের মত যখন মিনতি করছিলো ঠিক সেই সময় তার মুখটা ছেয়ে গিয়েছিল অপার্থিব কোনো এক মায়ায়। যা আজপর্যন্ত ঋজু কারো মধ্যে খুঁজে পায়নি।
প্রায় আড়াই সপ্তাহ পর ঋজুর সঙ্গে আবার দেখা হয় সবুজের, সেই বাস স্ট্যান্ডেই। সবুজই এগিয়ে এসে প্রথম কথা বলে, "স্যার শেষ চেষ্টা করেও বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না"।
ঋজু তার কামানো মাথা দেখে আগেই আন্দাজ করেছিল, তবে তার কথা শুনে বুকটাও কেমন যেন ধক করে উঠলো। বাবা হারানোর যন্ত্রণা তার থেকে ভালো আর কে বুঝবে। কিন্তু মনখারাপের যেটুকু বাকি ছিল সেটাও পূর্ণ হয়ে গেল যখন সবুজ বলল, "মা তো অনেক আগেই চলে গিয়েছিল আর আজ বাবাকেও ধরে রাখতে পারলাম না"।
কথা গুলো বলে জামার হাতা দিয়ে চোখ মোছে সে।
সেদিন বাসে ওঠার পর পাশপাশি দুটো সিট খালিও পেয়ে যায় তারা। যাত্রাপথের একঘেয়েমি কাটাতে শুরু হয় সুখ দুঃখের গল্প....
সেই থেকেই শুরু। ধীরে ধীরে দুজনের সম্পর্কের একটু একটু করে পদোন্নতি হতে থাকে। সম্মোধন আপনি থেকে কখন যে তুই তে গিয়ে ঠেকেছে দুজনের কেউই সেটা খেয়াল করেনি। সবুজ একটা বেসরকারি অফিসে স্টেনোগ্রাফারের কাজ করে। তথাকথিত বেতনের মাপকাঠিতে দুজনের সামাজিক পদমর্যাদার আকাশ পাতাল তফাৎ থাকলেও তা কোনোদিন তাদের বন্ধুত্বের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি।
বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রামের সব জমিজমা বিক্রি করে সবুজ অফিসের কাছাকাছি ছোট একটা একতলা বাড়ি কিনেছে। রবিবারের সন্ধ্যেটা ঋজু বেশির ভাগ দিন সেখানেই কাটায়। সেরকমই এক রোববারের সন্ধ্যে। দুকামরার সেই ছোট্ট বাড়িতে বসেছে চায়ের আড্ডা। গল্প করতে করতে অনেকক্ষন কেটে গেছে। একসময় সবুজ বলে ওঠে
- এই ঋজু ছাদে যাবি?
- এখন? এখন কি করবি ছাদে গিয়ে?
- চল না, রাতের আকাশের মাধুর্যতা দেখতে পাবি।
সিঁড়ি দিয়ে দুই জোড়া পা ধীরে ধীরে ছাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আকাশের কালো রং ততক্ষণে গাঢ় হয়েছে। চাঁদের হলদে ছটা ছড়িয়ে পড়ছে সারা ছাদ জুড়ে। আকাশে অনেক গুটি গুটি সাদা বিন্দু। কোনোটা দপদপ করছে আবার কোনোটা স্থির। ঋজু রাতের আকাশ আগেও দেখেছে তবে তার ভেতর আহামরি কিছু খুঁজে পায়নি। সেইতো একই চাঁদ, তারা আরো কত কি। কিন্তু আজ সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে বড্ড ভালো লাগছে তার। সবুজ একসময় দূরে আকাশের নির্দিষ্ট জায়গায় আঙ্গুল দেখিয়ে বলে
- জানিস ঋজু ওই যে উজ্জ্বল তারাটা দেখছিস ছোটবেলায় মা আমাকে ওটা দেখাতো। এটা তো কিছুই না। আমাদের গ্রামে রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকালে আরো অনেক তারা দেখা যায়। সে এক অন্য রকম অনুভুতি। মা আমাকে আকাশের তারা চেনাত। কোনটা ধ্রুবতারা, কোনটা কালপুরুষ এই আর কি। আর ওই নাম না জানা উজ্জ্বল তারাটাকে দেখিয়ে বলতো মা চলে গেলে আকাশের ওই তারাটা থেকে আমায় দেখবে। তাই যখন মাঝে মাঝে মার কথা মনে পড়ে তখন রাতের এই তারা ভরা আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। কি জানি বাবাও হয়তো কোন একটা তারা থেকে আমার দিকে নজর রাখছে।
ঋজু কিছু বললো না। শুধু নিঃশব্দে ডান হাতটা সবুজের কাঁধে রেখে তারা দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর নিজেই বলে উঠল
- এই সবুজ আমি তো ভুলেই গেছি আসার সময় তোর আর আমার জন্য দুটো ক্যাডবেরি এনেছিলাম। দেখ গরমে হয়তো গলেই গেছে। চল নিচে যাই ক্যাডবেরি খেলেই দেখবি তোর মন ভালো হয়ে যাবে।"
এই পর্যন্ত বলে থামলেন শুভ্রবাবু। তিনি থামতেই সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, "তারপর... তারপর কি হলো"? খাটের পাশের টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে সেটা শেষ করে আবার শুরু করলেন তিনি....
"ঋজুর আশঙ্কাই সত্যি হলো। ক্যাডবেরি দুটো একদম গলে গেছে। প্যাকেটটা ছিঁড়তে গিয়েই কিছুটা চকোলেট হাতে লেগে গেল তার। আর খাওয়ার সময় গাল, ঠোঁট সব ক্যাডবেরিতে মাখামাখি। তার এই কান্ড দেখে সবুজ তো হেসে কুটিপাটি। সে এগিয়ে এসে হাত দিয়ে মুছিয়ে দিতে থাকে সেগুলো। তারপর একসময় নিজেরটা ছেড়ে ভাগ বসায় ঋজুর ঠোঁটে লেগে থাকা ক্যাডবেরির উপর। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনায় পাথর হয়ে যায় ঋজু, তারপর একঝটকায় ঠেলে সরিয়ে দেয় তাকে। সবুজও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দুজনে এমন ভাব করতে থাকে যেন একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো অস্তিত্বই নেই তাদের জীবনে।
সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে ঋজু বারবার সন্ধেবেলা়র কথা ভেবে চলেছিল। সবুজের ক্ষনিকের সেই স্পর্শ মনে করে তার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। নিজের অজান্তেই সেই স্পর্শ পুনরায় পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রইলো সে। হয়তো জানলোও না ঠিক সেই সময় আরেকজনও তার মতই আজকের ঘটনার স্মৃতিচারণে মশগুল।
দুজনের সেই একই ঘটনার স্মৃতিচারণ হোক কিংবা বন্ধুত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রেমের বীজ তারপর থেকেই শুরু হলো একটু একটু করে তাদের কাছে আসা। ধীরে ধীরে অনুভূত হতে লাগলো একে অপরের প্রতি অমোঘ টান। মুখ ফুটে কিন্তু কাওকে সে কথা বলতে হয়নি একবারও। অন্য সব যুগলদের মত তাদেরও মাঝে মাঝে দেখা যেত পড়ন্ত বিকেলে কোনো ফুচকার স্টলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে, কখনও আবার বসে থাকতে সিনেমা হলের পাশাপাশি দুটো সিটে কিংবা হারিয়ে যেতে ব্যস্ত শহরের কোনো অনাবিষ্কৃত কানা গলিতে।
সেদিন ঋজুর বাড়িতে সবুজের নেমন্তন্ন। এই বাপ-মা মরা সরল ছেলেটির উপর তার মায়ের অনেক টান। তাই মাঝে মধ্যেই তাকে ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়ান। আর সবুজও কাকিমা বলতে একেবারে অজ্ঞান।
খাওয়া দাওয়ার পর ঋজুর ঘরে বসে গল্প করছিল সবুজ। হঠাৎ করেই আকাশটা ঘন কালো মেঘে ছেয়ে এলো। বৃষ্টি হচ্ছিল না কিন্তু খুব ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল। তার ছোঁয়ায় বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেই শীতলতার ভেতরেও দুটি মন খুঁজে নিয়েছিল উষ্ণতার স্পর্শ।
সুখ-দুঃখ সমান্তরালে রেখে এভাবেই কাটছিল দুটি জীবন। এরমধ্যে হঠাৎ করেই ঋজুর মায়ের খুব শরীর খারাপ। তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া করা হলো তাকে। হার্টের কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল ওনার। প্রায় দুই সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ঋজু আর সবুজ পালা করে থাকতো সেখানে। কখনো বা দুজনে একসাথেও থাকতো। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পর সেদিন রাত্রে ঋজুর মায়ের শরীরটা আবার একটু খারাপ করলো। ঠিক সেই সময়ই সবুজের ফোনটা এলো। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবুজের ফোনটা রিসিভ করলো সে
- হ্যালো ঋজু?
- হ্যাঁ বল।
- বলছি একবার আমার বাড়িতে একটু আসতে পারবি?
- এখন এত রাতে? কিসের জন্য আমি এখন যেতে পারবো না।
একটু যেন বিরক্ত হয়েই বললো সে। ওপার থেকে সবুজ বলতে লাগলো
- আসলে শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে, মাথাটাও ধরে আছে।
- আমি কি করবো তাতে? আমি কি ডাক্তার নাকি? আর মায়ের শরীরটা আবার একটু খারাপ হয়েছে আমি তাই যেতে পারবো না এখন।
- ও তাই নাকি কাকিমা কেমন আছে এখন?
- বললাম তো ভালো নেই তাও এই অবান্তর প্রশ্নের মানেটা কি?
- আচ্ছা বুঝতে পারছি তোর মন ভালো নেই। ঠিক আছে কালকে কিন্তু আমার অনেক প্ল্যান আছে, তুই কিন্তু সকাল সকাল চলে আসিস।
- এত স্বার্থপর তুই আমি আগে বুঝতে পারিনি। নিজের খুশিটাই তোর কাছে সব হলো তাইনা। এদিকে আমার জীবনের একমাত্র সম্বল আমার মা অসুস্থ সেদিকে তোর কোনো খেয়াল নেই ছিঃ।
কথাগুলো বলে ফোনটা কেটে দিল সে। কিন্তু তারপর থেকেই একটা ব্যথা কুরে কুরে খেতে লাগলো। সবুজের সাথে এটা কি করলো সে। কিন্তু তারই বা কেমন আক্কেল দেখছে মায়ের এই অবস্থা..
সেই রাতে সবুজের আরো দুবার ফোন এলো, কিন্তু ফোনটা সাইলেন্ট অবস্থা থাকায় সেটা বুঝতেই পারলো না ঋজু।
রাতের বেলা ডাক্তার এসে ঋজুর মাকে দেখে গেছেন। বলেছেন চিন্তার কিছু নেই, প্রেসারটা একটু বেড়ে গেছিলো। সকালে উঠে ঋজু দেখলো তার মা তখনো ঘুমাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিতেই সবুজের দুটো মিসড কল চোখে পড়লো তার। আর সেই সময়ই তার আগের রাতের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সে হন্তদন্ত হয়ে রওনা দিল সবুজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সবুজের বাড়ির দরজায় টোকা দিয়েও তার কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। অনেক ডেকেও সাড়া না পাওয়ায় জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো ঋজু। আশপাশ থেকে প্রতিবেশীরা ছুটে এলো। সবাই মিলে প্রস্তাব দিল দরজা ভাঙ্গার। শেষ পর্যন্ত দরজা ভাঙ্গা হলো। প্রথমে সবুজের শোয়ার ঘরে ঢুকেই ঋজু ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। সবুজ উপুড় হয়ে পড়ে আছে, পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা স্টীলের গ্লাস। হয়তো রাতের বেলা জল খেতে গিয়েই এই অবস্থা। তক্ষুনি প্রতিবেশীদের মধ্যে থেকে একজন ডাক্তারকে খবর দিল। আধ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার এসে নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, 'উনি আর বেঁচে নেই".......
তারপরের কাজকর্ম গুলো ঋজুই একা হাতে সামলালো। মাঝখানে বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। ফোনটা নিয়ে সে দেখে তার মা ফোন করেছে। সে ফোনটা ধরে বলে
- হ্যালো?
- হ্যাঁ বাবাই তুই কোথায়? আমি সকালে উঠেই দেখি তুই বেরিয়ে গেছিস। আজ তো রোববার আজ না ব্যাঙ্ক বন্ধ? আর তোর গলাটা ওরকম ধরা ধরা লাগছে কেন রে?
- না মা ও কিছু না আসলে সবুজ একটা ভালো জায়গায় চাকরি পেয়েছে। ওকে শহর ছেড়ে বাইরে যেতে হবে সেই জন্যই হাতে হাতে সব গুছিয়ে দিচ্ছিলাম।
- তাই নাকি সেতো খুব ভালো কথা, কিন্তু ও দূরে চলে যাবে এটা ভেবেই খারাপ লাগছে। আচ্ছা শোন ওকেও আজ সঙ্গে করে নিয়ে আসিস। আজ তোর জন্মদিন সেটা মনে আছে কি?
এত কিছুর মাঝে এই দিনটার কথা ঋজু ভুলেই গেছিল। নিজের কান্নাটাকে কোনমতে চেপে সে বললো
- আচ্ছা মা।
ফোনটা কেটে দিলো ঋজু। সবুজকে তার মা নিজের ছেলের মতো করেই ভালোবাসে, তাই এই খবরে তার হার্টের যদি কোনো ক্ষতি হয় সেই ভেবেই তাঁর কাছে আসল কথাটা চেপে যায় সে।
সবুজের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে তার দেহ তখন হাসপাতালে। ডাক্তার আন্দাজ করছে হয়তো ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। পোস্টমর্টাম করা হবে। সেই মনখারাপ করা বিকেলে সবুজের শুন্য ঘরে নিঃশব্দে প্রবেশ করে ঋজু। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে সবুজের গায়ের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে। মাঝের এই সময়ের মধ্যে একবারও কাঁদেনি সে। হয়তো অনুভূতিহীন হয়ে গেছে তার মন। হঠাৎ তার চোখ যায় বালিশের দিকে। তার নিচ থেকে উঁকি মারছে একটা সাদা কাগজের অংশ। ক্ষিপ্র হাতে সেটা হতে তুলে নেয় ঋজু। একটা চিরকুট জাতীয় কিছু। সেটা খুলে পড়তে আরম্ভ করে সে। চিঠিটা কিছুটা এইরকম
প্রিয় ঋজু,
জানি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছিস। কাকিমা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন দেখিস। তোর হয়তো এতকিছুর মধ্যে মনে নেই কাল তোর জন্মদিন। তাই অনেক প্ল্যান ছিল তোকে নিয়ে। আমার জীবনে তুই আর কাকিমা ছাড়া আর কেউ নেই রে, তাই তোদের ছেড়ে শুধু নিজেরটা আমি কখনোই ভাবতে পারি না। শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না কয়েকদিন ধরে। তুই এমনিতেই চাপে আছিস তাই বলিনি। আজ না পেরেই ফোন করেছিলাম। জানিনা কেনো যেন মনে হচ্ছে কালকের ভোরের প্রথম পাখির ডাকটা আমি আর শুনতে পাবো না। তাই লিখে রেখে গেলাম। আমি স্বার্থপর নই ঋজু... আমি স্বার্থপর নই।
শেষের দিকের লেখা গুলো কেমন কাঁপা কাঁপা। সেই অনন্ত শূন্যতায় ভরা কাগজটা নিয়ে একজনের ফেলে যাওয়া স্মৃতি ঘেরা সেই ছোট্ট ঘরটিতে কেঁদে উঠলো ঋজু। যাওয়ার আগে আর বলা হলো না
- খুব ভালোবাসি রে তোকে, নিজের সমস্তটা দিয়ে ভালোবাসি।"
গল্পটা শেষ করে থামলেন শুভ্রবাবু। সকলের চোখের কোণে লেগে আছে স্বচ্ছ মুক্তোর বিন্দু। শুভ্রবাবু বললেন, "ভালোবাসা কোনো নিয়ম মেনে হয়না; ভালবাসা দেখে না কোনো ভেদাভেদ, সময়, স্থান, কাল, পাত্র। কেমন যেন হয়ে যায়.... হঠাৎ করেই হয়ে যায়। জানি এরকম ভালোবাসার গল্প তোমাদের নিশ্চই ভালো লাগেনি তাইনা?সময় যতই এগোক জীবনে যতই আধুনিকতার ছোঁয়া আসুক এই প্রেম একপ্রকার নিষিদ্ধ হয়েই থেকে গেল।"
তনয় বলল, "বাবা ভালোবাসায় সব হয়, সে হোক না দুটি ছেলে কিংবা দুটি মেয়ের মধ্যে তাতে শুধু প্রয়োজন অন্তরের শুদ্ধতার, আর শুধু আমি কেন তোমার বৌমা আর নাতনিও হয়তো এটাই বিশ্বাস করে।"
মিলি আর সোমলতা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সোমলতা তার দাদুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে
- আচ্ছা দাদু গল্পটা শুনে তো মনে হলো না সেটা কোনো গল্প তাহলে কি তুমি ঋজুকে চেন?
- দিদিভাই ছোটবেলায় মা আমাকে ঋজু বলে ডাকতেন।
শুভ্রবাবুর উত্তরে সবাই চুপ করে গেল। তিনি আবার বললেন
- চলো আজ তোমাদের সবুজের সাথে দেখা করাই।
এই বলে তিনি পা চালালেন বাগানের উদ্দেশ্যে। বাকি তিনজন মনের ভেতর নানা প্রশ্নের জট ছাড়াতে ছাড়াতে তাকে অনুসরণ করল। শুভ্রবাবু বাড়ির পেছনের বাগানে তার নিজে হাতে লাগানো প্রিয় বটগাছটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। এই গাছে আজ পর্যন্ত একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগতে দেননি তিনি। গাছটির গায়ে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন
- এর নিচেই শায়িত আছে সবুজ। এই গাছের সমস্ত ডালপালা গুলো বেড়ে উঠেছে তার দেহের প্রতিটি কোষের রস গ্রহণ করে। রূপান্তর ঘটেছে তার দেহসত্তার। তবে মন কিন্তু একই আছে।
এই কথা বলার সাথে সাথেই এক ঝলক হাওয়া এসে দুলিয়ে দেয় গাছের পাতাগুলো। আলোড়ন ওঠে ডালপালায়। সেই শিরশির শব্দে কান পাতলে শোনা যায় মনের গোপন কোন কথা.....
Comments
Post a Comment